শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : জীবনে যারা কখনো ক্ষণিকের জন্য কল্পনাই করেননি জমিসহ ঘরের মালিক হবেন; তাদেরই প্রতিচ্ছবি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার প্রতিবন্ধি শাহীন আক্তার, ভিক্ষুক মাসুদা বেগম, স্বামী ত্যাজ্য সখিনা বেগম ও জেলে ফয়েজ আহমদ। এখন তারা জমিসহ ঘর পেয়ে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে।
মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় তৃতীয় পর্যায়ে জমিসহ ঘর পাচ্ছেন এসব মানুষ। আর ঈদের আগে নিজেদের মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠাঁই হওয়ায় সুবিধা বঞ্চিত এসব মানুষের উচ্ছ্বাস যেন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে রূপ নিয়েছে।
শাহীন আক্তার, যাকে চলাফেরা করতে হয় এক পায়ে ভর করে। অন্যের ঘরে গৃহকর্মি হিসেবে কাজ করে দু’বেলা ভাতের নিশ্চিত করলেও ছিল না নিজের মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই। মাকে নিয়ে তিনি থাকতেন কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার উপকূলবর্তী বারবাকিয়া ইউনিয়নের জারুলবনিয়া এলাকার জনৈক ব্যক্তির বাড়ীর বর্ধিত ঝুপড়িতে।
মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় হত-দরিদ্র সেই শাহীন এখন জমিসহ ঘর পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আর ঈদের আগে স্বপ্নাতীত সেই ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হওয়ায় এখন ভাসছেন উচ্ছ্বাসের জোয়ারে। এ জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি।
শাহীন আক্তার বলেন, জন্মগত প্রতিবন্ধি তিনি। বাম পায়ে চলৎশক্তি না থাকায় তাকে এক পায়ে ভর করে চলাফেরা করতে হয়। সংসারে বৃদ্ধ মা ছাড়া তার কেউ নেই। তাই বাবার মৃত্যুর পর থেকে দু’বেলা অন্ন যোগাতে অন্যের বাড়ীতে কাজ করেন গৃহকর্মি হিসেবে। এতে অন্ন-সংস্থানের একটা পথ থাকলেও ছিল না মাথা গোঁজার ঠাঁই।
“ এ কারণে পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের জারুলবনিয়া এলাকায় জনৈক ব্যক্তির বাড়ীর বর্ধিত অংশে ঝুপড়িতে আমি মাকে নিয়ে থাকতাম। এতে বৃদ্ধ মাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত অন্ন ও আশ্রয়ের দু:শ্চিন্তা তাড়া করে বেড়াতো। ”
সরকারের কাছ থেকে জমিসহ ঘর পেয়ে প্রতিবন্ধি শাহীন আক্তারের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রতিচ্ছবি।
শাহীন বলেন, “ আমার মত প্রতিবন্ধিদের সরকার ঘর উপহার দেওয়ায় খুবই আনন্দিত। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দোয়া করছি, সরকার যেন আমার মত আরও বেশী মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। ”
শুধু শাহীন আক্তার নন; পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের ভিক্ষুক মাসুদা বেগম, স্বামী ত্যাজ্য সখিনা বেগম, জেলে ফয়েজ আহমদও পেয়েছেন জমিসহ নতুন ঘর।
এদের সঙ্গে মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় তৃতীয় পর্যায়ে কক্সবাজারের ৯ টি উপজেলায় ৮৬৭ টি পরিবারও পেয়েছেন এ ধরণের ঘর। যারা জমিসহ নিজের ঘরে ঠাঁই নেওয়ার স্বপ্ন দেখেননি কখনো। তারা এখন ঘর পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি।
পেকুয়ার রাজাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা ভিক্ষুক সখিনা বেগম বলেন, গত ৬ বছর আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে তার স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে ৩ শিশু সন্তান নিয়ে তার চরম দুর্দশায় দিন কাটছিল। স্বামীর জীবিত অবস্থায় থাকতে সরকারি খাস জমিতে। পরে সেই জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা কেড়ে নেওয়া মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়ও হারান। তাই ভিক্ষাবৃত্তি করে তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।
“ আমি এখন সরকারের কাছ থেকে জমিসহ ঘর পেয়েছি। এখন মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠাঁই হওয়ার পাশপাশি নিজের সামান্য জমিতে হাঁস-মুরগী ও পশু পালনসহ ফসলের চাষ করা সম্ভব হবে। আমাকে ভবিষ্যতে আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে হবে না। এটি আমার জন্য জীবনের পরম পাওনা। ”
উপকারভোগী ভিক্ষুক সখিনা আরও বলেন, “ সরকারের এ মহতী উদ্যোগ আমার জীবনকে বদলে দিচ্ছে। এখন স্বপ্ন দেখছি সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করার। এ জন্য সরকার প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি জানাই দোয়া ও কৃতজ্ঞতা। ”
একই ধরণের অনুভূতির কথা জানান পেকুয়ার রাজাখালী ইউনিয়নের স্বামী ত্যাজ্য মাসুদা বেগম।
মাসুদ বলেন, বিয়ের ১০ বছর পর সংসারে স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে। তিন সন্তান থাকলেও তারা বাপের বাড়ীতে থাকে। সংসারে বিচ্ছেদের পর থেকে তার বাবার বাড়ীতে থাকেন। বাবার বাড়ীর আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় অন্যের বাড়ীতে কাজ করে চলে তার জীবন।
“ কিন্তু বাবার বাড়ীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও ঘরটি ছিল জীর্ণ-ছিন্ন। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কোন রকমে ঘরটিতে থাকতাম। এখন সেই জায়গায় সরকারের পক্ষ থেকে নতুন একটি ঘর তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আমি খুবই খুশি। ”
আর ঈদের আগে নতুন ঘরে ঠাঁই হওয়ায় আনন্দে অন্যরকম অনুভূতি লাগছে বলে মন্তব্য করেন উপকারভোগী স্বামী ত্যাজ্য এ নারী।
পেকুয়ার জেলে ফয়েজ আহমদ জানালেন, সরকার জমিসহ নতুন ঘর উপহার দেওয়ায় পরিবার নিয়ে এখন আর যাযাবরের মত জীবন কাটাতে হবে না। নিজের কোন বসত জমি না থাকায় আগে অন্যের বাড়ীতে পরিবার নিয়ে থাকতে হত। এখন নিজের জমি ও ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হওয়ায় স্বপ্ন দেখছেন সন্তানদের নতুন জীবনের।
পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা বলেন, জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে সারাদেশের মত পেকুয়া উপজেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের আশ্রয়ের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে ৪৫ টি পরিবার, দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৫ টি এবং তৃতীয় পর্যায়ে ৭১ টি পরিবারকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাদের প্রত্যেককে ২ শতক করে জমি দিয়ে একটি নতুন ঘর তৈরী করে দেওয়া হয়। পেকুয়ার রাজাখালী, শিলখালী ও টৈটং ইউনিয়নের তিনটি স্থানে এসব সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
“ তৃতীয় পর্যায়ে প্রস্তাবিত ৭১ টি পরিবারের মধ্যে প্রথম ধাপে ৪০ টি পরিবারকে মঙ্গলবার জমি ও ঘরের মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছে। অপর ৩১ টি পরিবারকেও ঘরগুলোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে দ্বিতীয় ধাপে হস্তান্তর করা হবে। ”
তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম ধাপে যে চল্লিশটি পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে তারা সকলেই প্রতিবন্ধি, ভিক্ষুক, স্বামী ত্যাজ্য, জেলে ও দিনমজুর সহ নানা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ বলেও জানান পেকুয়ার ইউএনও।
এদিকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, তৃতীয় পর্যায়ে যে ৮৬৭ টি পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হচ্ছে তারা অধিকাংশই সুবিধা বঞ্চিত। এসব পরিবারকে বিদ্যুৎ ও পানিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করা হয়েছে। এক কথায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়া এসব মানুষের এলাকাগুলো যেন একেকটি উপশহর; যাতে যাতায়ত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার সংস্থান হয়- এমন উপযোগী ব্যবস্থা রয়েছে পরিবারগুলোর জন্য।
জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তিন দফায় কক্সবাজারে জমিসহ ঘর পেয়েছে ২ হাজার ৮৮৬ টি পরিবার। পর্যায়ক্রমে আরো এক হাজার ৮৮৪ টি পরিবার ঘর পাবে।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply